“জননেতা একেএম শামসুজ্জোহাকে আসন্ন সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য পদে নারায়ণগঞ্জ আসনে নৌকা মার্কায় ভোট দিন”। সাদাকালো রংয়ের মলিন পোস্টারের মাঝে জোহা চাচার নিস্পাপ চেহারার এই ছবিটি শোভা পাচ্ছিল নারায়ণগঞ্জ হাই স্কুলের বিভিন্ন শ্রেণী কক্ষের দেয়ালে। সেটা ছিল ১৯৭৪ সন আমি সবেমাত্র স্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হয়েছি। ই-সেকশন ছিল আমার শ্রেণীকক্ষ। ক্লাসে বসে জানালার ফাক গলিয়ে বাইরে সাটানো পোস্টারের দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকতাম আর ভাবতাম সংসদ সদস্য হলে কত টাকা বেতন পাওয়া যায়। জোহা চাচার সাথে আমার প্রথম পরিচয় এভাবেই।
লক্ষী নারায়ন কটন মিল এলাকা থেকে দামি সাইকেলে চড়ে স্কুলে আসতো আমার বন্ধু সহিদুল ইসলাম বাবুল। আমার প্রিয় বন্ধু। সম্ভবত তখনকার দিনের দি মাস্টার ব্রান্ডের সাইকেলটা চালানোর জন্য আমি সর্বক্ষণ বাবুলের সাথে লেগে থাকতাম। বাবুলের পকেট ভর্তি টাকা থাকতো সেই তখন থেকেই। ওর বাবা সেই মিলে একাউন্টস সেকশনে চাকরি করতো। ফলে বাবুলের কাছ থেকে কারণে অকারণে সাইকেল চেয়ে নেয়া আর ফুচকা খাওয়া তখন আমার জন্য নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
বাবুলকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম তোর বাবা মাসে কতো টাকা বেতন পায়? বাবুল অবাক না হয়ে উল্টো আমাকে জিজ্ঞেস করলো কতো টাকা পেলে তুই খুশী হবি? এবার আমি বাবুলকে বললাম দোস্ত জোহা সাহেব মাসে কতো টাকা বেতন পায় তুই কি জানিস? আমার প্রশ্ন শুনে বাবুল বললো আরে বেটা জোহা সাহেবরা তো নারায়ণগঞ্জের জমিদার। তারা তো বেতন পাওয়ার জন্য রাজনীতি করে না। কতো মানুষকে উনারা জমিদার বানাইয়া দিসে তুই জানস না। বাবুল তখন বললো উনি যে রাজনীতি করেন সেই আওয়ামী লীগের কোন কর্মী ঠিকমতো কিছু চাইলেই জোহা সাহেব সবকিছু উজাড় করে দিয়ে দেন। বেশীর ভাগ কাজ তিনি ফোনের মাধ্যমে করে দেন। আমি অবাক হয়ে চোখ বিষ্ফোরিত করে বাবুলকে বলতাম তুই এতো কিছু কিভাবে জানলি? সে বলতো বাবায় কইছে। বাবুলের বাবা বরিশাল থেকে নারায়ণগঞ্জ এসে তখন ওই চাকরিটি করছিল। বাবুল তখন তাঁর সাইকেলে চড়িয়ে আমাকে উত্তর চাষাড়ায় নিয়ে জোহা সাহেবের বাড়ির সামনে নিয়ে গেল দেখানোর জন্য। সেই প্রথম আমি ‘হীরামহল’ এর সাথে পরিচিত হলাম।
সে বছরের শেষ দিকে আমার বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেল। তারপর ১৯৭৭ সনে আমার বোনের ঘরে কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে। আমাদের অতি আদরের ভাগ্নীর নামকরণ করা হলো ‘নাগিনা’। অনেকের চরম অপছন্দ সত্বেও দুলাভাই নিজে এই নামটিই প্রতিষ্ঠিত করলেন পরিবারের অন্য সদস্যদের বিরুদ্ধে চরম লড়াই করে। দুলাভাইকে জিজ্ঞেস করলাম নাগিনার নামের পেছনের কাহিনীটা কি? তিনি বলেছিলেন একজন মহিয়সী রমনীর নাম নাগিনা। সেই রমনী আমার নেতার সহধর্মিণী। আর তাই আমি আমার মেয়ের নাম নাগিনা রাখতেই মনস্থির করেছি। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর ভাল করবেন। পরে জেনেছিলাম উপমহাদেশের প্রথম কো-অপারেটিভ ব্যাংক দি নারায়ণগঞ্জ টাউন কো-অপারেটিভ ব্যাকের চেয়ারম্যান ছিলেন একেএম শামসুজ্জোহা। আর জোহা সাহেব ডেকে নিয়ে দুলাভাইকে ব্যাংকের সচিবের চাকরিটি দিয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত দুলাভাই সেই চাকরিতেই বহাল ছিলেন।
দুলাভাই বলতেন অনেক বর্তমান ও প্রয়াত নেতার নাম ধরে, তারা জোহা সাহেবের বাড়িতে যেতেন ১০০/২০০ টাকার মিস্টি নিয়ে। আর তাঁরা চাইতেন লাখ লাখ টাকার ব্যবসা। সিংহ হৃদয় জোহা সাহেব এক টেলিফোনে তাদেরকে সেসব কাজ করে দিতেন। জতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট স্বপরিবারে শাহাদাত বরন করার পর জোহা সাহেব গ্রেফতার হন। মুক্তিলাভের আগে পর্যন্ত আমি দেখেছি দুলাভাইকে জোহা সাহেবের বাসায় গিয়ে খোঁজ খবর নিতে। মুক্তিলাভের পরও দেখেছি দুলাভাইকে জোহা চাচার সান্নিধ্যে ছিলেন এবং সব সময় যোগাযোগ রাখতেন তাঁর সাথে।
সেটা ১৯৮৩/১৯৮৪ সাল। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ দেশের প্রেসিডেন্ট। দেশে তখন সামরিক শাসন চলছে। তিরাশির ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ শেষে আমি তখন তরুণ ছাত্রনেতা। তখন কমিউনিস্ট পার্টির সার্বক্ষনিক কর্মী আমি। পনের দল তখন হয়ে গেছে। ভবিষ্যৎ আন্দোলন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তমূলক সভার জন্য গোপন স্থান নির্ধারণ করা হয় চাষাড়ায় নাজমা রহমানের বাড়িতে।
রথীন চক্রবর্তী ও রফিউর রাব্বি কোন রকমে তখনও গোপনে আমাদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রয়েছে। আমি উপস্থিত হলাম কমিউনিস্ট পার্টির গোপন সভায়। রথীন দা বললেন আমাকে রিপ্রেজেন্ট করতে হবে পনের দলের গোপন সভায়। আমি তাৎক্ষনিক রাজি না হলেও রাব্বি ভাই সায় দিয়ে বল্লেন আমাকেই যেতে হবে সেই সভায়। শেষে আমি উপস্থিত হলাম সেই গুরুত্বপূর্ণ গোপন সভায়। যতদূর মনে পরে মোহর আলী চৌধুরী, আবদুস সাত্তার, আবদুর রহমান, শফিউদ্দিন ভাই, রফিক খান, নাজমা রহমান ও জননেতা শামসুজ্জোহা উপস্থিত ছিলেন সেই সভায়। সেটা ছিল জোহা চাচার সাথে আমার প্রথম আনুষ্ঠানিক আলাপ পরিচয় ও সাক্ষাৎ। মাত্র দুই তিন মিনিটের কথাবার্তার মধ্য দিয়েই বুঝেছিলাম কতো উঁচু মনের ও মানের মানুষ ও রাজনৈতিক নেতা ছিলেন জোহা চাচা।
আজ তার ৩৪ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাই।
(মোস্তফা করিম- সাবেক সাধারন সম্পাদক,নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাব)
Leave a Reply