ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণ কামনায় দেশ বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লি আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করেন। মহামহিম, অসীম, অনন্ত, প্রেমময় ও দয়াময় আল্লাহ’র সন্তুষ্টি লাভে আকুতি ব্যক্ত করে নিজ নিজ কৃতি কর্মের জন্য চোখের পানিতে বুক বাসিয়ে ক্ষমা চান মহামহিমের দরবারে। ধনী-গরিব, মালিক-শ্রমিক নির্বিশেষে সর্বস্তরের লাখ লাখ মুসল্লি সবকিছু ভুলে দু’হাত তোলে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করেন। লাখ কন্ঠে উচ্চরন করেন আমিন ছুম্মামিন। প্রকম্পিত হয়ে উঠে টঙ্গীর আকাশ বাতাস।
রোববার ভোর থেকেই ফজরের নামাজ ও আখেরি মোনাজাতের জন্য পুরানো খবরের কাগজ, পাটি, সিমেন্টের বস্তা ও পলিথিন বিছিয়ে বসে পড়েন। এছাড়া পার্শ্ববর্তী বাসাবাড়ি-কলকারখানা-অফিস-দোকানের ছাদে, যানবাহনের ছাদে ও তুরাগ নদীতে নৌকায় মুসল্লিরা অবস্থান নেন। যে দিকেই চোখ যায় সে দিকেই দেখা যায় শুধু টুপি-পাঞ্জাবি পরা মানুষ। সবাই অপেক্ষায় আছেন কখন শুরু হবে সেই কাঙ্খক্ষিত আখেরি মোনাজাত। ইজতেমাস্থলের চারপাশের ৩-৪ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কোথাও তিলধারণের ঠাঁই ছিল না।
হাফেজ মাওলানা জোবায়ের আহমেদ মোনাজাতে বলেন, হে আল্লাহ তুমি তো ক্ষমাশীল, তোমার কাছেই তো আমরা ক্ষমা চাইব। দ্বীনের ওপর আমাদের চলা সহজ করে দাও। হে আল্লাহ, তুমি আমাদের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে যাও। আমরা যেন তোমার সন্তুষ্টি মাফিক চলতে পারি সে তওফিক দাও। দুনিয়ার সব বালা-মুসিবত থেকে আমাদের হেফাজত করো। নবীওয়ালা জিন্দেগি আমাদের নসিব করো। ইজতেমাকে কবুল করো। ইজতেমার আয়োজনে যারা শ্রম দিয়েছেন তাদের কবুল করো। যারা তোমার কাছে হাত তুলেছেন সবাইকে তুমি কবুল করো। ইজতেমার বক্তা ও শ্রোতা সবাইকে তুমি কবুল করো। দাওয়াতে তাবলিগকে বিশ্বব্যাপী প্রসারিত করো। হে আল্লাহ আমাদের ঈমানকে মজবুত করে দাও, আমাদের সবার মাঝে মানবতা বৃদ্ধি করে দাও, হে আল্লাহ আমাদের আখলাক হেফাজত করার তৌফিক দান করো, হে আল্লাহ শয়তানের ধোঁকা থেকে আমাদের হেফাজত করো, হে আল্লাহ আমাদের নবীর সাফায়াত নসীব করো।’
মুসল্লিদের বাঁধভাঙা জোয়ার : বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণকারীরা তো ছিলেনই, শুধু আখেরি মোনাজাতে শরিক হতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা ছুটে আসতে থাকেন শনিবার থেকেই। বাস, ট্রাক, মিনিবাস, কার, মাইক্রোবাস, ট্রেন, লঞ্চ ও স্টিমারে করে এসে টঙ্গীতে পৌঁছে অবস্থান নিতে শুরু করেন। রাজধানীসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকজন ভিড় এড়াতে শীত, কুয়াশা ও নানা ঝক্কিঝামেলা উপেক্ষা করে রাতেই টঙ্গীমুখী হন। সরকারি বেসরকারি অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সর্বত্রই ছিল পূর্ণ ছুটির আমেজ।
এর আগে শনিবার গভীর রাত থেকে টঙ্গীমুখী সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় দীর্ঘ পথ হেঁটে টঙ্গী পৌঁছতে হয়েছে লাখ লাখ মানুষকে। কয়েক লাখ মানুষ রাতেই ইজতেমার মাঠ কিংবা আশপাশের বাসাবাড়ি, ভবন, ভবনের ছাদ কিংবা করিডোর, সড়কের পাশে ফুটপাতে এমনকি গাছতলায় অবস্থান নিয়েছেন। সকাল ৮টার মধ্যে গোটা এলাকা জনতার মহাসমুদ্রে পরিণত হয়।
প্রথম পর্বের ইজতেমায় ৮ মুসল্লির মৃত্যু : গতকাল রোববার সকাল পর্যন্ত বিশ্ব এজতেমায় আগত ৮ মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন, ঢাকা বংশালের আনিসুর রহমান(৭১), খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানার মলমদিয়া গ্রামের মোবারক হোসেন খানের ছেলে মোফাজ্জল হোসেন খান(৭০), ঢাকা কেরানীগঞ্জের হাজী হাবিবুল্লাহ হবি (৬৮), চট্টগ্রামের রাউজান এলাকার আঃ রশিদ মিয়ার ছেলে আঃ রাজ্জাক(৭০) ও নরসিংদী জেলার মনোহরদী থানার মাছিমপুর গ্রামের মৃত রহমতুল্লার ছেলে হাবিবুর রহমান (৭০)। এর আগে ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকার আক্কাস আলি সিকদার (৫০), সিলেটের জৈন্তাপুরের নুরুল হক (৬৩) ও গাজীপুরের ভিরুলিয়ার তৈয়ব আবু তালেব (৯০) মারা যান। এ নিয়ে এজতেমায় প্রথম পর্বে মোট ৮ মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে।
মুসল্লিদের বাড়ি ফেরায় চরম দুর্ভোগ: মোনাজাত শেষে লাখো মুসল্লি তাদের নিজস্ব গন্তব্যে যেতে যানবাহন সংকটে পড়ে চরম দুর্ভোগের শিকার হন। মোনাজাত শেষে লাখ লাখ মুসল্লি ইজতেমা ময়দান থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে ¯্রােতের মতো এক সাথে ফিরতে শুরু করলে এক পর্যায়ে ময়দানের চতুর্দিকে ৬-৭ কিলোমিটার বিস্তীর্ণ এলাকা মানব বলয় সৃষ্টি হয়। কোনো যানবাহন চলাচল করতে না পাড়ায় মুসল্লিরা পায়ে হেঁটে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেন।
আকাশপথে টহল: বিশ্ব ইজতেমায় যাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে র্যাবের পক্ষ থেকে হেলিকপ্টারে পুরো টঙ্গী এলাকায় টহল দিতে দেখা গেছে।
বিনামূল্যে পানি বিতরণ : আগত মুসল্লিদের সুবিধার কথা চিন্তা করে ৪৯নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদপ্রার্থী আলহাজ্ব মোঃ কামাল দেওয়ান ও ৫৬নং ওয়ার্ড মহিলা আ.লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদীকা মোছাঃ ময়না বেগমসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নিজস্ব উদ্যোগে খাবার পানি, শুকনা বিস্কুট ও সরবত বিতরণ করেন।
মোনাজাতে ভিআইপিদের অংশগ্রহণ: শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার স্টেডিয়ামে অবস্থিত পুলিশ ক্যাম্পে প্রথম পর্বের ৫৬তম বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে শরিক হয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক এমপি, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল এমপি, গাসিক (ভারপ্রাপ্ত) মেয়র আসাদুর রহমান কিরন, গাজীপুরের পুলিশ কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম প্রমূখ।
মোনাজাতে মহিলাদের অংশগ্রহণ : আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে বিভিন্ন এলাকা থেকে কয়েক হাজার মহিলা মুসল্লিও ইজতেমা ময়দানের আশে পাশের বিভিন্ন শিল্পকারখানা, বাসা-বাড়ি ও বিভিন্ন দালানের ছাদে বসে আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন।
নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা: গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে পুরো ময়দানে প্রায় তিন’শ ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বসানো হয়েছে। ইজতেমায় মুসল্লিদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিল নির্ধারিত পোশাকের বাহিরে সাদা পোশাকের পুলিশ।
দুই বছর পর এবার দুই পর্বের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব রোববার সকালে আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে শেষ হয়েছে। মাঝে চারদিন বিরতি দিয়ে ২০ থেকে ২২ জানুয়ারি দ্বিতীয় পর্বের বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে।
Leave a Reply